শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩

সৌদি কেন ইসরাইলের সাথে সম্পর্কে জোর দিচ্ছে?

বৈশ্বিক অবস্থানের কারণে বহু বছর ধরেই গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ সৌদি আরব। দেশটিতে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি আবিষ্কৃত হয় গত শতকের ৩০ এর দশকে। যুক্তরাষ্ট্রের পর যদি কোনো দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জ্বালানি তেলের মজুত থাকে তবে তা হলো সৌদি আরব। বর্তমানে দেশটি বিশ্বের অন্য সকল দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জ্বালানি তেল রপ্তানি করে। এমনকি বিশ্বের শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির মধ্যে সৌদি আরবের অর্থনীতি একটি।

 

পূর্বে সৌদি আরবের সাধারণ মানুষেরা নিজেদের খেজুর বাগানে কাজ করতেন। তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো খেজুর রপ্তানি করার মাধ্যমেই। তাই বলে তেলের খনি থেকে তেল রপ্তানি শুরু হয়েছে বলে তারা যে খুব আরাম আয়েশের জীবন পার করছে তা কিন্তু নয়। কেননা সৌদি জাতি তাদের জ্বালানি তেল রপ্তানির পাশাপাশি গড়ে তুলছেন আরও নতুন ধরনের শিল্প। ফলে ভবিষ্যতে এই জ্বালানি তেল ফুরিয়ে এলে, বড় কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে না। মূলত এর প্রস্তুতি সৌদি আরব ২০১৫ সাল থেকেই নিয়ে আসছে।

 

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৬ সালে ঘোষণা করেন “ভিশন ২০৩০”, যার প্রধান লক্ষ্য হলো সৌদি আরবকে আধুনিক, উদার, ব্যবসা ও পর্যটনবান্ধব করে তোলা। সেদেশে নারীরা অবাধে গাড়ি চালানো, সিনেমা দেখতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা স্বাধীনভাবে বাস করা, মক্কায় হজ্জের জন্য নিবন্ধন করতে পারছে। এর জন্য তাদের প্রয়োজন হচ্ছে না বাবা বা অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয়ের অনুমতির।

- Advertisement -

 

সামাজিক সংস্কারে অগ্রসর হলেও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে নেই কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। তবে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য চলছে আলোচনা, নিয়েছে কিছু পদক্ষেপ। রাজতান্ত্রিক শাসন হওয়ার কারণে সৌদি আরবে জনগণের বাকস্বাধীনতা সীমিত। ফলে এসব পরিকল্পনা নিয়ে সৌদি সাধারণের মতামত জানার কোনো উপায় নেই বললেই চলে।

 

এরপরেও পুরো বিশ্বের সকল মুসলমানদের কাছে সৌদি আরব একটি আবেগের জায়গা। সৌদি আরবে অবস্থিত ইসলামের 2টি পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা। অন্যদিকে ইসরাইল তাদের জন্য খুবই অপ্রিয় একটা স্থান কারণ আরব ভূমি দখল করেই ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। মূলত এই কারণেই বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিম দেশ ইসরাইলের সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে চায় না। তবে তুরস্কসহ আরো কয়েকটি দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কথা ভেবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এইদিকে সৌদি আরব অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইলও চায় মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থিত সৌদি আরব সহ আরও বড় বড় আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে। কেবলমাত্র ইরান ছাড়া বাকি সব মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মূল চাবিকাঠি হলো সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। বরং ইরানও তাদের মোকাবিলার জন্যই সৌদির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাচ্ছে।

 

চলতি বছরের জুলাই মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জন ব্লিনকেন ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে কথা বলার জন্য সৌদি আরবেই চলে গিয়েছিলেন। সেই সময় ফিলিস্তিনের শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ব্লিনকেনকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সংবাদ মাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা যায়, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আরো বেশকিছু শর্তও জানিয়ে দিয়েছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে সৌদি আরবকেও কিছু দিতে হবে ইসরাইলের। এর মধ্যে আছে মার্কিন অস্ত্র। তবে এটি ছাড়াও সৌদি আরবে একটি বড় ব্যাপার ঘটতে চলেছে। দেশটি বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করতে চায়। যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন সিগন্যাল চাইছে সৌদি আরব। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্যারান্টিযুক্ত প্রতিরক্ষা চুক্তিও চাইছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স।

 

মোহাম্মদ বিন সালমান এর সাথে বৈঠকের পর অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে সৌদি আরবের শর্তগুলো জানিয়েছেন। কিন্তু ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্র কেউ এ সৌদি আরবের পারমাণবিক কর্মসূচির পক্ষে নয়। ‘বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি চায় সৌদি আরব’ – এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা কি? এর জন্য প্রয়োজন হবে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন। জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির কয়েকজন সদস্য সৌদি ক্রাউন প্রিন্সকে পছন্দ করেন না। যার ফলে তারা সৌদি আরবের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারে। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যদি সৌদি পরমাণু কর্মসূচিতে সম্মতি দেন তাহলে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার কঠোর বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হবে।

 

2020 সালে মার্কিন মধ্যস্ততায় সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি করে। এরপর মরক্কো ও সুদান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান আর বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে কথোপকথন চললেও সম্পর্ক তেমন স্বাভাবিক হয়নি। পারমাণবিক শক্তি নির্ভর দেশ হয়ে উঠতে সৌদি আরবের তৎপরতার কারণ হলো, পৃথিবীর উন্নত অংশটি এখন আর জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে থাকতে চাইছে না। তাই ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল বিক্রি করে দেশটি যেমন তার অর্থনীতিকে সবল রাখতে পারবে না, তেমনি নিজের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর কথাও ভাবতে হচ্ছে।

- YouTube -

 

এমনকি সৌদি আরবের মরুভূমির ভেতর ইউরেনিয়ামের মজুতও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তাই বেসামরিক কর্মসূচির দিকে দেশটি ঝুঁকতে পারলেই সব দিক দিয়ে ভালো। পারমাণবিক কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়েই পথ চলতে চেয়েছে সৌদি আরব। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মন এখন রাশিয়া আর চীনের উপর। ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে মান সম্মান আর থাকছে না। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যে প্রভাব প্রতিপত্তিতে ভাগ বসাচ্ছে। এই অবস্থায় সৌদি আরবের মত পুরোনো বন্ধুর দিকে খুব বেশি মনোযোগ দিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় হাতছাড়া হতে চলেছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই।

- Advertisement -

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

  • সাবস্ক্রাইব করুন তথ্যবহুল সত্য খবরের জন্য 

    You are our valued subscriber. We send weekly newsletter. NO SPAM

আরও পড়ুন

মূল্যস্ফীতি ব্যাপার আসলে কি, কিভাবে নিরোধন হয়

মূল্যস্ফীতি কী?   অর্থনীতিবিদদের মতে, আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা...

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি,সংসারে দীর্ঘশ্বাস

“৫ কেজি চাউল কয়দিন যাবে বাহে, সরকারক কন সারা...

শ্রীলঙ্কা কীভাবে অল্প সময়ে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়াল?

মাত্র দেড় বছর আগেই যে দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে...

ডি- ডলারাইজেশন: বিকল্প মুদ্রায় কারা লাভবান হবে?

ডলার! শব্দটিতেই একটি ভাব গম্ভীর্য রয়েছে। ধরুন,আপনি ইন্দোনেশিয়া ঘুরতে যাবেন।সেখানে...

দেশে আসছে ডিজিটাল ব্যাংক ; স্বপ্ন থেকে বাস্তবতায়

প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে...