ইরানের রাজধানী তেহরানে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া। ইরান এবং হামাস এ জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
একই সময় লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় আরেক হিজবুল্লাহ কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যকে আরও বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এর ফলে ইতালির রোমে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে চলমান আলোচনার সাফল্য নিয়ে নতুন সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দেশ এ হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
গাজার বাসিন্দারা ক্ষোভ ও শোক প্রকাশ করে বলেছেন, হানিয়া তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। হামাস বলেছে, শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ আন্দোলনই বিজয়ী হবে।
হামাস এবং ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর বুধবার (৩১ আগস্ট) পৃথক বিবৃতিতে হানিয়ার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
প্রসঙ্গত, ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত মঙ্গলবার তেহরানে গিয়েছিলেন হানিয়া। যে ভবনে তারা অবস্থান করছিলেন, সেখানে হামলা চালানো হলে হানিয়া এবং তার একজন দেহরক্ষী নিহত হন।
সৌদি গণমাধ্যম আল হাদাৎ বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে জানিয়েছে, স্থানীয় সময় গত বুধবার মধ্যরাতে তেহরানে হানিয়ার ব্যক্তিগত বাসভবনে নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হেনে হামাস নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড জানিয়েছে, হানিয়া উত্তর তেহরানে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের এক আবাসিক এলাকায় ছিলেন আর সেখানে ‘আকাশ থেকে আসা একটি অস্ত্রের আঘাতে’ নিহত হয়েছেন।
৬২ বছর বয়সি এই নেতা তেহরানে গিয়ে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা মুসা আবু মারজুক হানিয়া হত্যার জবাব দেওয়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন। এ হামলাকে তিনি ‘কাপুরুষোচিত কাজ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
হানিয়ার মৃত্যু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েল। তবে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন।
এ ছাড়াও দেশটির কয়েকজন রাজনীতিক হানিয়ার মৃত্যু নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এর আগে গত জুনে ইসমাইল হানিয়ার পারিবারিক বাসস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। ওই হামলায় তার বোনসহ অন্তত ১০ জন নিহত হন।
তার আগে এপ্রিলে রোজার ঈদের দিন ইসরায়েলি বিমান হামলায় হানিয়ার তিন ছেলে এবং বেশ কয়েকজন নাতি-নাতনি নিহন হন। চলমান এই যুদ্ধে হানিয়ার ৬০ স্বজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
হানিয়া ফিলিস্তিনের ছিটমহল গাজায় জন্মগ্রহণকারী সেখানে বেড়ে উঠলেও বেশ কয়েক বছর ধরে কাতারের দোহায় বসবাস করছিলেন। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের চলমান পরোক্ষ আলোচনা তত্ত্বাবধান করছিলেন। তার মৃত্যুতে এই প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে।
হানিয়াকে হত্যার ঘটনায় গাজার ফিলিস্তিনিরা শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মধ্য গাজা উপত্যকার দেইর এল-বালার বাসিন্দা আহমেদ আল নিমস বলেছেন, ‘হানিয়া গাজার ছেলে। তিনি আমাদের সমগ্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।’
এদিকে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ফুয়াদ শোকরকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। গত মঙ্গলবার রাতে এ ঘোষণা দেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক নাদের হাশেমি বিবিসিকে বলেছেন, হানিয়াকে হত্যার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের বেশি কাছে নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘এটি উত্তেজনার বড় ধরনের এক বৃদ্ধি। এর কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরায়েল দক্ষিণ বৈরুতে হিজবুল্লাহর এক জ্যেষ্ঠ নেতাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, ফলে এটি লেবাবনের ঘটনাগুলোকেও প্রভাবিত করবে বলে মনে করি আমি। আগে ধারণা ছিল, ইরান ও হিজবুল্লাহ সংঘাত আর বাড়াতে চায় না। কিন্তু, হানিয়া হত্যার ঘটনা ওইসব হিসাবনিকাশকে উল্টে দিয়েছে। এখন ইরান এই সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যেকটি পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।’
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো এবং স্ট্র্যাটেজিক আউটরিচের সিনিয়র ডিরেক্টর ফিরাস মাকসাদ বলেছেন, হানিয়া হত্যাকাণ্ড ইরান সমর্থিত ছায়াশক্তি এবং ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনাকে ‘সম্পূর্ণ বদলে’ ফেলতে পারে।
তিনি সিএনএনকে বলেন, তেহরান এখন নিজেই ইসরায়েলের সরাসরি প্রতিক্রিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের নিয়ে আসবে।