জাতির জনক, রাষ্ট্রপ্রতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন । বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর হিসাবে এটি হবে সরকারিভাবে প্রথম পরিদর্শন।
বঙ্গবন্ধুকে সাদর সংবর্ধনা জানাতে উন্মুখ হয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা আর কর্মচারীরা।
কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে প্রবেশ করে প্রথমেই স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ শিক্ষকদের মাজার জিয়ারত করবেন। একইসাথে পুষ্পমাল্য অর্পণ করারও কথা ছিল তাঁর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউওটিসি’র ক্যাডেটরা প্রত ছিল বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ জানাতে। সেদিন সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। শুধু তাদেরই কথা ছিল বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করার।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর মধ্যে একমাত্র সমাজবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিভাগেই যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি পূর্বনির্ধারিত ছিল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে একটা ‘জাদুঘর’ করা হয়েছিল, কথা ছিল বঙ্গবন্ধু তা পরিদর্শন করবেন। আরো কথা ছিল, সায়েন্স অ্যানেক্স ভবন অতিক্রম করার পথে পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের ডাটা প্রসেসিং ইউনিটও পরিদর্শন করবেন বঙ্গবন্ধু । ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত ছাত্রদের গণকবর দেখতে জাতির পিতা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করবেন এবং সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন। পরিদর্শন কর্মসূচির সর্বশেষ বিষয় ছিল কার্জন হল। সবার শেষে বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রেএখানে একটি সমাবেশের আয়োজন ছিল, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,অফিসার, কর্মচারী এবং ছাত্রদের সম্মিলিত সভা হবে বলে কর্মসূচি তৈরি কররাখা হয়েছিল। এই সভার সময় নির্ধারিত ছিল বেলা ১১টা ৪০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকী সম্মান জানানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের নতুন মনোগ্রামের একটি ক্রেস্ট তৈরি করে রেখেছিলেন রুপো দিয়ে। এছাড়া রবীন্দ্রভক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্র-রচনাবলির কয়েক যশুণ্ড সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। বোঝা যায়, রবীন্দ্র-রচনাবলির সবকটি খণ্ড বাংলাদেশে তখনো সহজলভ্য ছিল না। তা না হলে পূর্ণ খণ্ড রবীন্দ্র-রচনাবলি কেন নয়, মাত্র কয়েকটি খণ্ড বঙ্গবন্ধুকে দেয়ার জন্য কেন তৈরি ছিল।
এই সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিও এদিন ঠিক করে রাখা হয়েছিল। কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী এদিন একযোগে বাকশালে যোগদান করার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে দরখাস্ত পেশ করবেন । এই দরখাস্ত যাঁরা জমা দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে প্রচণ্ড বাকশাল-বিরোধী হিসেবে বিশ্ববাজারে নিজেদের পরিচিত করে তুলতে ব্যস্ত ছিলেন।
দুর্ভাগা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগমন উপলক্ষে চা- পানের কথা ছিল ড.মতিন চৌধুরীর বাসভবনে। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী রান্নাঘরে নিজেদের হাতে তৈরি করেছিলেন হালকা ধরনের বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবারগুলো কয়েকটি। তাদের সেই আশা সেদিন পূরণ হয়নি কোনোদিন হবেও না। এ দুঃখ নিয়ে ইতোমধ্যে লোকান্তরিত হয়েছেন বোস প্রফেসর ড. মতিন চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগমনে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত ছিল এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তখন জাতীয় ছাত্রলীগ গঠিত হয়ে গিয়েছে এবং এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক শেখ শহীদুল ইসলাম ছিলেন প্রায় সকল আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-তে তখন সহ- সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং মাহবুব জামান। তারাও সম-অংশীদার ছিলেন এই আয়োজনের। বঙ্গবন্ধু সেদিন ছিলেন সকল শ্রেণির দল ও মতের ঊর্ধ্বে। সকল ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁকে অভিবাদন জানাতে প্রস্তুত ছিলেন সেদিন ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালের সকাল ১০টা ৫ মিনিটে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আর সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কর্মসূচির মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে বঙ্গবন্ধুকে ভোরবেলা ঘাতকরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বরাবরই একটা দুঃখবোধ ছিল। ১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীরা কতকগুলো দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন এই আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সরকার এই ধর্মঘট ও আন্দোলনের ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করায় সংগ্রাম শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। উপরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সর্বমোট ২৭ জন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।
যেসব ছাত্রনেতার নাম এতে ছিল তাদের মধ্যে দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, উমাপতি মিত্র, আবদুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুব আলী, অরবিন্দ বসু, নইমুদ্দিন আহমদ, নাদেরা বেগম এবং শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। এদের মধ্যে ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ১৫ জনকে ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার, ৫ জনকে ১৫ টাকা এবং ১ জনকে ১০ টাকা জরিমানা করা হয়।
যাঁরা বহিষ্কৃত হয়েছিল তাদের জন্য অন্তত চার বছর পর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার সুযোগ ছিল। যাঁদের জরিমানা করা হয়েছিল তাদের কেউ কেউ জরিমানা দিল, কেউ কেউ ক্ষমা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পড়াশুনা শুরু করেছিল। কিন্তু জরিমানা দিতে অস্বীকার করলেন শুধু একজন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার তাঁর জন্য চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল। সাধারণ কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন করার ‘অপরাধে’ ক্ষমা চাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। জরিমানা দেয়াও সেদিনের তরুণ শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বের পক্ষে ছিল অসম্ভব। আত্মমর্যাদার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। একজন ছাত্রের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা নিজ পড়াশোনা শেষ করা। সেই আকাঙ্ক্ষার পাশে সেদিনের ছাত্র শেখ মুজিব তাঁর নিজ সম্মানকে বিক্রি করতে পারেননি। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের ছেদ ঘটে।
সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত, প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৬-৫৭ সালের ডাকসু সিদ্ধান্ত নিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক নেতারা কোনো সভা- সমিতি উপলক্ষ করে অংশ নিতে পারবেন না। ডাকসুতে তখন ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষমতায়। কিন্তু এই সময় ছাত্রলীগের একটি সভায় প্রধান অতিথি করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ছাত্রলীগের তখন সভাপতি ছিলেন আবদুল আউয়াল। বঙ্গবন্ধুকে সাথে করে ছাত্রলীগ সভাপতি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে, তখন ডাকসু সহ সভাপতি একরামুল হক সেখানে হাজির। ডাকসু ভিপি বুঝিয়ে বললেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু খুব হাসিমুখে ডাকসু নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে আসলেন।
বস্তুত আজকের দিনে ইতিহাস বিচার করলে স্বীকার করতে হবে এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর সেদিনেও প্রবেশ করা হলো না ।
এটা কি শুধুই একটি ট্র্যাজেডি যে, ১৯৭৫ সালে একটি স্বাধীন দেশের জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গবন্ধুর শেষপর্যন্ত তাঁর প্রিয় সেই শিক্ষাঙ্গনে যাওয়া হলো না! আত্মমর্যাদার প্রশ্নে যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন, বাঙালির জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে যিনি পাকিস্তান থেকে ভাগ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশেই তিনি যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেদিনই তাকে হত্যা করা হলো কেন? সে কি নিছক ট্র্যাজেডি, নাকি অন্য কোনো কাকতালীয় কিছু!