মুজিব ইয়াহিয়ার আলোচনার আলোকে প্রেসিডেন্ট হাউস হতে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ পেয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলসহ ২১শে মার্চ ঢাকা আগমন করেন ।
ঢাকা আসার পরপরই তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের সাথে এক আলোচনায় মিলিত হলেন । দুই ঘন্টা ব্যাপী বৈঠকে কি আলোচনা হয়েছে সংবাদপত্রে তার কিছুই প্রকাশিত হয়নি। সাংবাদিকরা ভুট্টোর সাক্ষাৎ পায়নি। এই তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবেরও একটা অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক ৭০ মিনিট চলে। এ বৈঠকের বিবরণও, ঠিক আগের মতই, কিছুই জানা গেল না । তবে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, আজকের বৈঠক আশ্চর্যজনক যা আকস্মিক এমন কিছুই নয়। প্রেসিডেন্ট ও আমি যতক্ষণ এখানে আছি, ততক্ষণ প্রয়োজনের স্বার্থে যে কোন সময় যেকোন ব্যাখ্যার প্রশ্নে আমরা আলোচনায় মিলিত হতে পারি । উভয়ের মধ্যে আলোচনাকৃত ব্যাখ্যা সমূহের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাওয়া হলে শেখ মুজির নীরব থাকেন। পরে বললেন, ইতিপূর্বের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় প্রশ্নের ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আমরা নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি।
এই দিন দৈনিক আজাদ তার এক রাজনৈতিক রিপোর্টে লিখল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের চার দফা শর্তের ব্যাপারে একটা গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা প্রণয়নের পরই মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে এবং এই ফর্মুলা প্রণয়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন পাঞ্জাব প্রেসার গ্রুপ এর উপর নির্ভরশীল বলিয়া ওয়াকিফহাল মহল সূত্রে আভাস পাওয়া গিয়াছে । ——-বঙ্গবন্ধুর প্রথম শর্ত অর্থাৎ সামরিক শাসন প্রত্যাহারের প্রশ্নে একটি বিশেষ মহল যে বিরূপ চাপ অব্যাহত রাখিয়াছে, তাহাতে কার্যতঃ মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় জটিলতা সৃষ্টি হইয়াছে ।
২২শে মার্চ বেলা ১১টার দিকে প্রেসিডেন্ট ভবনে, মুজিব, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক চলাকালেই প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ অফিসার বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের এসে জানালেন, প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চ আবৃত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন । দেশের উভয় অংশের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের সুবিধার জন্যে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
বৈঠক ৭৫ মিনিট পর্যন্ত চলে। বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, এর আগে প্রেসিডেন্টের সাথে তিনি যে সব আলোচনা করেছেন, তা প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টোকে অবহিত করেন। আলোচনা সম্পর্কে কিছু বলতে শেখ মুজিব অস্বীকার করেন। আলোচনায় অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন, যদি কোন অগ্রগতি না হতো, তাহলে আমি কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি? ২৫শে মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা সম্পর্কে শেখ সাহেবের প্রতিক্রিয়া একজন সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, একথা আমাদের জানা আছে যে, আমি বলছিলাম আমাদের দাবী আদায় না পর্যন্ত অধিবেশনে যোগদান করব না। আমাদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতেই অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে । শেখ মুজিব সাংবাদিকের জানালেন, তিনি পুনরায় আজ (২৩ শে মার্চ) প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করবেন এবং তাদের উভয় পক্ষের উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হবে ।
২২শে মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বললেন, দেশের বর্তমান দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাপক সমঝোতা এবং মতৈক্যে পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছেন । সমঝোতার শর্তগুলো তাঁর দল পরীক্ষা করে দেখছে। ——–ব্যাপক সমঝোতা এবং সমঝোতার বিষয় বস্তু সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট তাঁকে ইতিপূর্বে অবহিত করেন।
উল্লেখ্য যে, এই মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় তিন মাসের জন্যে নিম্নলিখিত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যথা-
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার;
২. বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর;
৩. জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন;
৪. দেশ রক্ষা, বৈদেশিক নীতি (বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যতীত মুদ্রা ও পুঁজি পাচার নিষিদ্ধকরণ সহ) ছাড়া বাকি সর্বময় ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের হাতে থাকবে;
৫. তিন মাস অতিক্রান্ত হলে প্রত্যেক অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্যবর্গ সংবিধান রচনা কল্পে নিজ নিজ দৃষ্টিভংগী স্থিরীকরণের নিমিত্ত পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হবে। তৎপর সংবিধান সমস্যাবলীর সর্বগ্রাহ্য সমাধান নির্ধারণকল্পে সদস্যবর্গ যুক্ত বৈঠকে মিলিত হবেন । এই সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত রূপদানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে ১৯শে মার্চ, ২৩শে মার্চ ও ২৪শে মার্চ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এতদসংক্রান্ত চূড়ান্ত ঐকমত্যের বিষয় ঘোষণার কথা ছিল।