মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩

২৫শে মার্চ ১৯৭১

২৫শে মার্চ ১৯৭১। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখ- টিই হলো একটি ইতিহাস । ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের ১২০০ মাইল দূরের দু’টি অংশকে দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার তারিখ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয় আলাদাভাবে। পাকিস্তানের দুই অংশের বাঘা বাঘা নেতাদের সব আলোচনাকে সমাপ্ত করে ২৫শে মার্চের কালো রাতে ঘুমন্ত পূর্ব পাকিস্তানের উপর আঘাত হানে একের পর এক পশ্চিমা বোমার অগ্নিকুণ্ড। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় ইতিহাসের এক নতুন পর্ব । জনাব মওদুদ আহমদ তাঁর বই Bangladesh: constitutional Quest for Autonomy তে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আলোচনা করেন এভাবে, ২৫শে মার্চ বেলা ৯টায় ভুট্টো ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করলেন এবং ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টারা যে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিলেন তার প্রতি চূড়ান্তভাবে তাঁর না টা জানিয়ে দিলেন । যদিও প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় তিনি দাবী করলেন, আমরা কোন সমস্যা সৃষ্টি করছি না, তবু ভুট্টো বললেন, পূর্ব পাকিস্তান যে স্বায়ত্ত্বশাসন চাচ্ছে তা স্বায়ত্ত্বশাসনের সংজ্ঞার বিচারে সত্যিই স্বায়ত্ত্বশাসন নয়।

ঐদিন (২৫শে মার্চ) সকালেই ১০টার দিকে আমি ক্ষমতাসীন জেনারেলদের শেভ্রুলেট কারের একটি কনভয়কে প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকতে দেখলাম । জেনারেল হামিদ, ওমার, মিঠা, পীরজাদা এবং টিক্কা ইয়াহিয়ার সাথে একটি ভাগ্যনির্ধারণী বৈঠকে বসলেন যা চলল মাত্র ৩০ মিনিট । ফল হল এই, ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শাসনতান্ত্রিক আলোচনার যে রেজাল্ট আওয়ামী লীগকে জানানোর কথা ছিল, তা আর কোন দিনই জানানো হলো না । ২৫শে মার্চ বিকেলে মুজিব ক্যান্টনমেন্ট সোর্সে জানতে পারলেন। যে, রাজনৈতিক সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই এবং সেনাবাহিনী তার অভিযানের জন্য তৈরী হচ্ছে। বিকেলে ঐ একই উৎস থেকে মুজিবকে বলা হলো, ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করছেন। সেনাবাহিনীর আসন্ন অভিযানের রকম প্রকৃতি শেখ মুজিব অনুমান করতে পারলেন না। তিনি তাঁর চারদিকের সহকর্মী- দের তৎক্ষণাৎ ঢাকা শহর থেকে সরে যাবার পরামর্শ দিলেন এবং তোফায়েল, রাজ্জাক প্রমূখ যুব নেতাদের বুড়ি গঙ্গার ওপারে গ্রামাঞ্চলে সরে যেতে বললেন ।

রাত সাড়ে দশটার দিকে একটা সেনা ইউনিট রেডিও ও টিভি স্টেশনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল এবং সাড়ে এগারটা থেকে ব্যাপক আকারে গোলাগুলী শুরু হলো। মুজিব বাড়ীতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন ও আমি কয়েকজন বন্ধু সমেত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকা পড়েছিলাম। বাঙ্গালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল সব বিদেশী সংবাদদাতারাও সেখানে অবস্থান করছিলেন। তাঁরাও আটকা পড়লেন । ভুট্টো ১১০০ নং স্যুটে অবস্থান করছিলেন । রাত সাড়ে ১২ টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫৮ থেকে ৬০ টি গাড়ীর একটা বছর প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আমাদের হোটেল অতিক্রম করে বা দিকে ঘুরে শাহবাগের দিকে চলে গেল । সংগে সংগেই আমি হোটেল থেকে মুজিবের কাছে টেলিফোন করলাম । ফোনটা ধরলেন হাজী মোরশেদ। আমি তাকে জানাতে বললাম যে, আমার আশঙ্কা আর্মি মুজিবের বাড়ী আক্রমণ করতে পারে । তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরে পড়া দরকার। বারটা পঞ্চাশ মিনিটে মুজিবের বাড়ীতে পুনরায় টেলিফোন করলাম । এই সময়ও টেলিফোনের অপর পারে হাজী মোরশেদকে পেলাম । আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, মুজিব নিরাপদ জায়গায় সরেছেন কিনা । হাজী মোরশেদ কাঁদতে লাগলেন । বললেন, আমরা তাঁর পা ধরেছি এবং বার বার তাঁকে অনুরোধ করেছি বাড়ী থেকে সরে যাবার জন্যে । কিন্তু তিনি রাজী নন। তিনি দেখতে চান তাঁরা তাকে কি করে। রাত ১টা ১০ মিনিটের সময় যখন আমি পুনরায় মুজিবের বাড়ীতে টেলিফোন করার চেষ্টা করলাম । টেলিফোনের লাইন কাটা । মুজিব রাত ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে গ্রেফতার হন।

২৫শে মার্চের রাতে সেনা অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ মুজিবের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা জনাব রেহমান সোবহান বলেন, ——২৫শে মার্চের রাত ১১টায় সেনা অভিযান শুরু হল । এর কিছু আগে ইয়াহিয়া করাচী চলে গেলেন । যুদ্ধ এসে গ্রাস করল আলোচনাকে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত একটি সমাধান, যা সেদিন পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারতো, সেনাপতিদের হাতের মুঠোর মধ্যে ছিল, কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করল।

১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রেস স্টেটমেন্ট দেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর ব্যাপারে বলেন, ——২৫শে মার্চ রাত ১১ টার মধ্যে সেনাবাহিনীর লোকেরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে তাদের অবস্থান নিতে শুরু করল। সমসাময়িক ইতিহাসের এক নজীরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ঢাকার শান্তিপূর্ণ ও নিঃসন্দেহ জনগণের উপর গণহত্যার এর সুপরিকল্পিত কর্মসূচী চাপানো হলো । ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে কিছুই জানালেন না, তাঁর কোন চূড়ান্ত প্রস্তাবও আওয়ামী লীগের কাছে পেশ করলেন না। (Press statement issued by Mr. Tajuddin Ahmad, prime minister of Bangladesh, on 17th April, ।

- Advertisement -

২৫শে মার্চের রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে জনাব অলি আহাদ বলেন, সেদিন রাত ৯-৩০ মিনিটে বাংলা জাতীয় লীগের সদর দফতর হইতে আমি পূর্বদেশের প্রখ্যাত কলামিষ্ট জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাসায় যাই। তাঁহার সহিত অবস্থার আলোচনা-পর্যালোচনার স্বীয় বাসভবন মুখে রওনা হই। যাত্রাপথে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড রচনা করিতে দেখিতে পাই ভয়ার্ত অথচ সংকল্পে অটল জনতাকে । উদ্বিগ্ন ও উদগ্রীৰ জনতা স্থানে স্থানে আমার গাড়ী থামাইয়া পরিস্থিতি জানিতে চায়। আমি তখনও অনাগত হামলা সম্পর্কে কিছুই ওয়াকিফহাল ছিলাম না । পথিমধ্যে সর্বত্র ব্যারিকেড, উদ্বিগ্ন জনতার ভিড়। আঁচ করলাম, সংঘর্ষ অত্যাসন্ন এবং বোধহয় সর্বশেষ ফল সুখের নয় ।

বাসায় পৌঁছিয়াই জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে টেলিফোন করি এবং পথে পথে ব্যারিকেড ও উৎকণ্ঠিত জনতার সহিত আলোচনার বিষয়বস্তু তাহাকে জানাই । কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মিরপুর রোডের উপর সাঁজোয়া বাহিনীর গাড়ির আওয়াজ ও অহরহ গুলীর শব্দ শুনিতে পাই এবং টেলিফোনে জনাৰ চৌধুরীকে সে খবরও জানাই । রাত ১২টা দিকে পুনরায় জনাব চৌধুরীর সহিত আলাপ করিবার নিমিত্তে টেলিফোনের রিসিভার উঠাইয়াই বুঝিলাম টেলিফোন বিকল। চারদিকে তখন মুহুর্মুহু রকেট, মর্টার, মেশিন গান ও কামানের আওয়াজ, চতুর্দিকে আগুনের লেলিহান শিখা, ও গগনচুম্বি অন্ধকার ধোঁয়া।

- Advertisement -

কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

  • সাবস্ক্রাইব করুন তথ্যবহুল সত্য খবরের জন্য 

    You are our valued subscriber. We send weekly newsletter. NO SPAM

আরও পড়ুন

ভারত ও রাশিয়ার ভূমিকা

দুই পরাশক্তির অবস্থান বহির্দেশের মধ্যে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন...

বিশ্ববাসী জনমত গঠন

বিশ্ব জনমত ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ বিপ্লবকে পাকিস্তান একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন...

সেক্টরর্স

মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর...

পাকিস্তান-পূর্ব ভাষা বিতর্ক

ভাষাআন্দোলন ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।...

ঐতিহাসিক ছয় দফা

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসক...

২৪শে মার্চ ১৯৭১

২৪শে মার্চ তারিখেও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে কোন...

২৩শে মার্চ ১৯৭১

২৩শে মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এদিন সরকারী ও বেসরকারী...

২১শে মার্চ ১৯৭১

মুজিব ইয়াহিয়ার আলোচনার আলোকে প্রেসিডেন্ট হাউস হতে ঢাকা সফরের...

২০শে মার্চ ১৯৭১

২০ শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে...