জয় বাংলা! শুধুমাত্র দুটি শব্দ নয়; বরং বাঙালির চেতনা, ঐক্য, দেশপ্রেম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আইকনিক এই স্লোগান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের শোষণ, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছে। সফল অপারেশন শেষে অবধারিত ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে জয় উদযাপন করত। এর আগে বাঙালির কণ্ঠে কখনো এত তীব্র, সংহত এবং তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান উচ্চারিত হয়নি; যার একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য এবং জাতীয় আবেগ।
চার বর্ণের ছোট্ট দুটি শব্দের গতি ও শক্তি যেভাবে একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র যুদ্ধে উৎসাহিত করেছে, বিশ্বে তার দৃষ্টান্ত বিরল। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও স্লোগানর উৎপত্তি আরো আগে। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৬৯সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে যৌথভাবে শিক্ষা দিবস পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান জয় বাংলা স্লোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন। তবে এও প্রচলিত আছে, ১৯৭০সালের ১৯শে জানুয়ারি ঢাকা শহরের পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম জয় বাংলা স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন । ইতিহাসবিদদের মতে, ৭০-এর ৭ই জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে প্রথম যুক্ত করেন এই স্লোগানটি।
তবে এই স্লোগানের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় বলেছেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা থেকে ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ১৯২২ সালে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় এই শব্দদুটি ব্যবহার করেছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে জেলে থাকা অবস্থান তিনি লিখেছিলেন, “জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ! জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!” আবার কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবযুগ পত্রিকার ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি বলেন, বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সমাপ্ত করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে। এই ভাষণের পর থেকেই মূলত সাধারণ মানুষের কাছে স্লোগানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন এর কাছাকাছি শব্দ ছিল জিন্দাবাদ। মাওলানা ভাসানী ১৯৭১-এর শুরু থেকে স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ,আযাদ বাংলা জিন্দাবাদ, প্রভৃতি স্লোগান ব্যবহার করতেন। তবে একাত্তরের মার্চ থেকে জনসভা, মিছিলে এবং প্রচারণায় জয় বাংলা স্লোগানটি ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার প্রথম বেতার ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে। পরের দিন এটি রেডিওতেও প্রচারিত হয়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে বছরের পর বছর প্রায় নিষিদ্ধই ছিলো এই স্লোগানটি। অতপর স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ২০২২ সালের ২ মার্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।